জানা-অজানা

নায়িকা অলিভিয়া: চলচ্চিত্রের বিস্মৃত বনলতা

অনলাইন ডেস্কঃ
আয় রে মেঘ আয় রে, পরদেশী মেঘ রে,
আর কোথা যাসনে,বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দে ছায়া তারে…।
‘দ্য রেইন’ সিনেমার এ গান শুনলে দর্শকের স্মৃতিতে এখনো যেই নামটি ভেসে ওঠে, তা নিঃসন্দেহে ‘অলিভিয়া’। অবশ্য সেটা সত্তর দশকের দর্শকদের মনেই। এখনকার প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ভাবছেন, “অলিভিয়া আবার কে? এর নাম তো শুনিনি কখনো!”
হ্যাঁ, একসময়ের খ্যাতনামা নায়িকা- অলিভিয়া। তিনি নায়িকা চরিত্রেই সব সিনেমা করেছেন। কে জানে, হয়তো বৃদ্ধ হয়ে মা, দাদি-নানি কিংবা খালার চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি। তাই হয়তো নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয় থাকাকালীনই তিনি ক্যারিয়ারে ইতি টানেন। চলচ্চিত্রের দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার হতে পারে এটাও অন্যতম একটি কারণ।

চলুন জেনে নেয়া যাক অলিভিয়ার সম্পর্কে। তিনি কে ছিলেন? কীভাবে চলচ্চিত্রে তার আগমন, কেনই-বা এত বিখ্যাত থেকেও এই জগত থেকে বেরিয়ে গেলেন?
তাকে বলা হতো চলচ্চিত্রের বনলতা সেন। সত্যি নাটোরের বনলতা সেনের মতোই ছিল তার চোখ জোড়া। সত্তরের দশকে আলোচিত-সমালোচিত এক নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া গোমেজ। ১৯৭২ সালে চিত্রনির্মাতা এস এম শফীর ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ ছবির হাত ধরে নায়িকা অলিভিয়ার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। যদিও এর আগেই তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের কাছ থেকেই প্রস্তাব পেয়েছিলেন ‘লে্ট দেয়ার বি লাই্ট’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য। তখন তিনি একটি স্বনামধন্য হোটেলে কাজ করতেন।
‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে তাকেই (অলিভিয়া) পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও কোনো এক অজানা কারণে পরবর্তী সময়ে তাকে বাদ দিয়ে ববিতাকে নেয়া হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের কৌতূহলী দৃষ্টি ঠিকই আটকে যায় অলিভিয়ার দিকে। একে তো জহির রায়হানের মতো পরিচালক,তার উপর আন্তর্জাতিক বাজারের উদ্দেশ্যে নির্মিত ছবি, যা কিনা বহু ভাষায় অনূদিত হবে। এরকম একটি চলচ্চিত্রের নায়িকা হওয়া সামান্য কোনো বিষয় ছিল না। আর সেরকম একটি ছবিতে যদি অভিজ্ঞদের রেখে একেবারে নতুন কোনো নায়িকাকে নির্বাচন করা হয়, সেটা সকলের জন্যই ছিল বেশ কৌতূহলজাগানিয়া। আর সে কৌতূহল থেকেই তার পরিচিতি ঘটে সবার সাথে; আর সেই সঙ্গে ঘটে চলচ্চিত্র জগতের সাথে।

পারিবারিক জীবন
অলিভিয়ার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানের করচিতে। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। করাচি থেকে ঢাকায় এসে তারা বসবাস শুরু করেন মগবাজারের ইস্পাহানি গলিতে। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে বড় বোন থাকতেন কলকাতায়, যিনি ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মেজ বোন অডিট ছিলেন কেবিন ক্রু। ছোট বোন অলকা থাকেন কানাডায়। আর বাবা কাজ করতেন দৈনিক অবজার্ভার পত্রিকার রিডিং সেকশনে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করা অলিভিয়া গোমেজ মাত্র ১৩ কি ১৪ বছর বয়স থেকেই মডেলিং করা শুরু করেন। জীবিকার খাতিরে তিনি হোটেল পূর্বানীতে রিসিপশনিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। সে সময় বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো তার। আর এ হোটেলে চাকরিরত অবস্থায়ই তার সাথে দেখা হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এস এম শফীর, যাকে তিনি ১৯৭২ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন।

চলচ্চিত্র ছাড়ার কারণ
১৯৯৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এস এম শফী মারা গেলে অলিভিয়া শোকাহত হয়ে চলচ্চিত্রের জগত ত্যাগ করেন। এরপর আর তাকে পর্দার সামনে আসতে দেখা যায়নি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,
ফিল্মে যোগ দিয়েছিলাম নেহায়েত শখের বশে। প্রায় ৫৩টির মতো ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম এস এম শফীকে। যদিও আমাদের সন্তানাদি ছিল না, তবুও সুখী হতে পেরেছিলাম। স্বামীর মৃত্যুতে আমি ভেঙে পড়ি, এরপর শোকে একদিন ফিল্ম জগত ছেড়ে দিলাম।
গ্রহণযোগ্যতা
সত্তরের দশকে চলচ্চিত্রে আসা জনপ্রিয় নায়িকাদের মধ্যে অলিভিয়া ছিলেন অন্যতম। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের রক্ষণশীল বৈশিষ্ট্যের বাইরে অভিনয় করে অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, হয়েছেন অনেক সমালোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও। চরিত্রের প্রয়োজনে যেকোনো পোশাকে সাজতে তিনি কখনো অস্বস্তি বোধ করেননি।

‘বাহাদুর’ ছবিতে বেশ খোলামেলা থাকার কারণে তাকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আবার ‘দ্য রেইন’ ছবিতে তার শক্তিশালী অভিনয়ের জন্য তিনি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। তার কাজের ধরনে ছিল সাহস, সাচ্ছন্দ্য এবং সফলতা। চরিত্রের দরকারে তিনি সাহসী ছিলেন; সামাজিক, ফ্যান্টাসি, রোমান্টিক- সবধরনের ছবিই তিনি করে গেছেন। তার এ সাহসিকতার জন্য নামের সাথে যোগ হয়েছিল ‘গ্ল্যামারাস’, ‘আবেদনময়ী’ এই শব্দগুলো। গণমাধ্যমও যেন আবেদনময়ী নারী চরিত্রেই তাকে বারবার বসাতে চেয়েছে।
ক্যারিয়ারে মোট ৫৩টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তার মধ্যে ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘পাগলা রাজা’, ‘একালের নায়ক’, ‘কুয়াশা’, ‘চন্দ্রলেখা’, ‘শপথ নিলাম’, ‘জীবন সঙ্গীত’, ‘আগুনের আলো’, ‘টাকার খেলা’, ‘দূর থেকে বলছি’, ‘সেয়ানা’, ‘সতীনাথ কন্যা’, ‘মাসুদ রানা’, ‘লাল মেমসাহেব’, ‘লুটেরা’, ‘নাগ-নাগিনী’, ‘জংলি রানী’, ‘গুলবাহার’, ‘শাপমুক্তি’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মুক্তি না পাওয়া দু’টি সিনেমা হলো ‘মেলট্রেন’ এবং ‘প্রেম তুই সর্বনাশী’।
নায়ক ওয়াসিমের সাথে তার জুটি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। ওয়াসিম–অলিভিয়া জুটির ‘দ্য রেইন’ (১৯৭৬) সিনেমাটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তবে শুধু ওয়াসিম নন, প্রবীর মিত্র, মেহফুজ আজিম, মাহমুদ কলি, রাজ্জাক, সোহেল রানা প্রমুখ অন্যান্য বিখ্যাত নায়কের বিপরীতেও তিনি কাজ করেছেন।
এ সিনেমার ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না’ গানটি দিয়েই সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী রুনা লায়লা জাতীয়ভাবে সমাদৃত হন। একই ছবির ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায় তখন। সে সময়ে তিনি লাক্সের মডেল হওয়ার সম্মানও পেয়েছিলেন। অভিনয়ে তার যথেষ্ট পারদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও আকর্ষণীয়া নারী হিসেবেই যেন তার খ্যাতি বেশি ছিল। তবে অভিনয়ে তার দক্ষতা কতটুকু, তা বোঝা যায় নায়করাজ রাজ্জাকের বিপরীতে ‘জাদুর বাঁশি’ সিনেমায়।
উত্তমের বিপরীতে অলিভিয়া

অলিভিয়া গোমেজ ছিলেন প্রথম ও শেষ বাংলাদেশি নায়িকা, যিনি মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে কাজ করেছেন। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘বহ্নিশিখা’ চলচ্চিত্রে তারা দু’জন একসাথে কাজ করেছিলেন। সঙ্গে আরো ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী ও রঞ্জিত মল্লিক। অলিভিয়াই ছিলেন ববিতার পর একমাত্র নায়িকা, যিনি সে সময়ে কলকাতায় অভিনয়ের সৌভাগ্য অর্জন করেন।
কিন্তু রোজিনা ও অঞ্জু ঘোষের চলচ্চিত্রে আগমন অলিভিয়ার সাম্রাজ্যে যেন পতন নিয়ে আসে। খুব দ্রুতই ‘রাজমহল’ (১৯৭৯) দিয়ে রোজিনা এবং ‘সওদাগর’ (১৯৮২) দিয়ে অঞ্জু ঘোষ চলচ্চিত্রের বাজার দখল করে নেন। সেখানে অলিভিয়া ক্রমেই তার শক্ত অবস্থান হারাতে শুরু করেন।
একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই অভিনেত্রী চাইলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু তিনি ক্যারিয়ারের প্রতি কিছুটা খামখেয়ালী গোছের হওয়ায় সত্তরের দশকের উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই হয়তো তাকে চেনেন না।

যেমন আছেন এখন
প্রথম স্বামী এস এম শফীর মৃত্যুর পর তিনি শোকাহত হয়ে এ জগত থেকে বেরিয়ে আসেন। ১৯৯৫ সালে ‘দুশমনি’ ছবিতেই তাকে শেষবারের মতো দেখা যায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছেন, কাছের মানুষদের সঙ্গেই আনাগোনা চলে শুধু। পরে তিনি বিয়ে করেন ফতুল্লা্র মুনলাইট টেক্সটাইল মিলের কর্ণধার হাসানকে। বর্তমানে বনানীর ডিওএইচএসে বাস করছেন অলিভিয়া। পরিবার নিয়ে সুখে জীবন-যাপন করছেন সেখানে। তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম অভিনেত্রী ববিতা বলেন,
আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় তার। এখনো আগের মতোই হাসিখুশি আছে ও। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই কাটছে তার জীবন। অভিনেত্রী হিসেবে যেমন অসাধারণ, বাস্তবেও তেমনি অসাধারণ ভালো মনের মেয়ে অলিভিয়া।

Comment here