বিশেষ প্রতিবেদন

নাজিরপুর ও চিতলমারী চরের জমি নিয়ে তিন দশক ধরে চলছে হানাহানি

ফিরোজ মাহমুদ:
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার পশ্চিম চর বানিয়ারী গ্রাম ও বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা উমাঝুরি গ্রামের মধ্য দিয়ে বল্লেশ্বর নদ। প্রায় অর্ধশত বছর আগে বল্লেশ্বর নদ নাব্যতা হারালে দুই তীরে জেগে ওঠে চর। ওই চরের মালিকানা নিয়ে তিন দশকের বেশী সময় ধরে দুই উপজেলার দুই গ্রামবাসীর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। প্রতিবছর ধানের আবাদ ও ফসল কাটার মৌসুমে ঘটছে ছোট বড় সংর্ঘষ। এ নিয়ে দুই জেলার দুই থানায় ১৯টি মামলা হয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল পশ্চিম বানিয়ারী গ্রামের চরের জেগে ওঠা বিরোধপূর্ণ জমির ধান কাটা নিয়ে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার উমাঝুরি ও নাজিরপুরের পশ্চিম বানিয়ারী গ্রামের দু’পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ১০জন আহত হন। এ ঘটনায় নাজিরপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের ২ রা মার্চ সন্ধ্যায় চরের বিরোধপূর্ণ জমির মাছের ঘেরের দখল নিয়ে চিতলমারী উপজেলার উমাঝুরি ও নাজিরপুরের চর বানিয়ারী গ্রামের দু’পক্ষের মধ্যে সংর্ঘষ হয়। ওই রাতেই চর বানিয়ারী গ্রামের মৃত নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ওই বাড়ী কেয়ারটেকার কমলেশ বিশ্বাস বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামী করে নাজিরপুর থানায় একটি মামলা করেন এবং প্রতিপক্ষের মিজান শেখ বাদী হয়ে বাগেরহাট আদালতে একটি মামলা করেন।

মৃত নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের ছেলে জগদিশ চন্দ্র বিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব। তিনি স্বপরিবারে ঢাকায় থাকেন। নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের মেয়ে প্রিয়া সাহা। তিনি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার স্বামীর বাড়ী যশোর জেলায়। প্রিয়া সাহা সম্প্রতি ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হারিয়ে গেছে। তার বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবে তার এ অভিযোগকে পুরোপুরি মিথ্যা ও কাল্পনিক বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।

উপজেলা ভুমি অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৫০ সালের আরএস ম্যাপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, নাজিরপুরের জেএল নং-২৪, চর বানিয়ারী মৌজা ও চিতলমারীর জেএল নং-১১, চর বানিয়ারী মৌজার সীমানার মধ্যবর্তী স্থানে বল্লেশ্বর নদের অবস্থান ছিল। নদ ভরাট হয়ে চর জেগে ওঠায় ৮১ দশমিক ৮৭ একর জমি নিয়ে দুই উপজেলার সীমানা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। মুলত ১৯৮৩ সাল থেকে এ বিরোধ চলে আসছে। দুই উপজেলার ভুমি অফিস থেকে চরের জমি বন্তোবস্ত দেয়া হয়। পরে আদালত আন্তজেলা সীমানা পিলার স্থাপনের নির্দেশ দেন। সীমানা পিলার স্থাপন করা হলেও তা দুর্বৃত্তরা তুলে ফেলে। বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে নাজিরপুরের চর বানিয়ারী ও চিতলমারীর উমাঝুরি গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রতিবছর জমি দখল, ধান চাষ, পাকা ধান কাটা, মাটি কাটা, ঘেরের মাছ ধরা ও ঘেরে মাছ চাষ নিয়ে হানাহানি লেগে আছে। আন্তজেলা সীমানা নিয়ে ২০০৫ সালের ১০ মে ভুমি জরিপ অধিদপ্তর সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপন করে। পরে পিলারগুলো তুলে ফেলা হলে ২০১৩ সালের ১৯ জুন ভুমি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সীমানা চিহ্নিত স্থান বাতিল করে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য কৃষ্ণপদ রায় বলেন, এ এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছি। তবে চরের জমি নিয়ে দুই উপজেলার দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। দুই পক্ষের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান রয়েছে।
উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বুলু বলেন, ওই এলাকায় এ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, তা সব চরের জমি দখল ও মালিকানা নিয়ে। দুই উপজেলার অন্তত শতাধিক পরিবার এর সঙ্গে জড়িত।
জগদিশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ীর কেয়ারটেকার ও অগ্নিসংযোগ মামলার বাদী কমলেশ বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ইউপি সদস্য নজরুল সরদার ও তার লোকজন ঘরে আগুন দিয়েছে। তবে তিনি কাউকে আগুন দিতে দেখেননি বলে স্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের ছেলে জগদিশ বিশ্বাস তাদের পক্ষে প্রভাশালী ব্যাক্তি। তিনি যাতে স্থানীয়দের পক্ষে সহযোগিতা না করেন, সে জন্য তাকে ভয় দেখাতে তার ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে।

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য নজরুল সরদার জানান, চরের জমি নিয়ে স্থানীয় দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। উভয় পক্ষে হিন্দু-মুসলিম রয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে ঘর পোড়ানোর অভিযোগ সঠিক নয়।
জগদিশ চন্দ্র বিশ্বাস মুঠোফোনে বলেন, আমি ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। বাবার ঘরটি ছিল আমার ঘর। গ্রামে আমার কোন শক্র নেই। আমার ঘরে কেন আগুন দেয়া হলো, তা বলতে পারবো না। বোন প্রিয়া সাহা সর্ম্পকে তিনি কোন কথা বলতে চাননি।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওই স্থানে সীমানা নির্ধারনের জন্য গত মাসে দুই জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর সভা করেছে। ওই সভার কার্যবিবরণী পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Comment here