বিশেষ প্রতিবেদন

প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরের সাড়ে ১৪ লক্ষ মানুষ

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
সাগর উপকূলের জেলা পিরোজপুর নদী বেষ্টিত হওয়ায় বরাবরের মতো এবারও সুপার সাইকোন আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল ও সর্বশেষ সুপার সাইকোন আম্ফানে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এজেলায় অন্তত সাড়ে ১৪ লক্ষ মানুষের বসবাস। সুপার সাইকোন আম্পানের আঘাতে পিরোজপুরের সর্বত্র যে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা দৃশ্যমান তা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্থ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তারা।
সব মিলিয়ে জেলায় সর্বমোট ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান ২৬ কোটি টাকা বলে দাবী করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসনের কাছে দেয়া তাদের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে, ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপনের সার্বিক দিক বিশ্লেষনে এবার বেশী এগিয়ে রয়েছে কৃষি, মৎস্য ও গবাদি-পশুর ক্ষতি সেক্টর। প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ রক্ষা করতে হলে টেকসই বেড়ীবাধ নির্মানের কোন বিকল্প নেই। বেড়ী বাধ ও পর্যাপ্ত পাইলিং এর অভাবে জোয়ার বাড়লেই বাড়ে আংতক। পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে মানচিত্র। এ আতংক যেন এই এলাকার মানুষের নিত্য দিনের সংঙ্গী হয়ে আছে। নদী তীরবর্তী বাসীন্দার সংখ্যাও এখানে অনেক বেশি। কিন্তু নদী তীরবর্তী অধিকাংশ এলাকায় বেড়ি বাঁধ না থাকায় হুমকির মুখে রয়েছে ওই সব এলাকার বাসীন্দারা। কৃষি নির্ভর এলকা হওয়ায় ফসলের তিসহ নানা মুখী ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট বেড়ীবাঁধের পরিমান ২শ’ ৯৩.১ কিঃ মিঃ। জেলার ৭ টি উপজেলায় বিগত কয়েক বছরে ২০ দশমিক ৫৯৫ কিঃ মিঃ এলাকা খুবই ক্ষতিগ্রস্থ। এগুলি রার ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা চাহিদাপত্র চেয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
অপরদিকে বিভিন্ন বিভাগের ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিবেদনে কৃষি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ১১৯ হেক্টর জমি, যার আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৯২ হাজার ৪ শত টাকা। ক্ষতির দিক থেকে এর পরের স্থানে রয়েছে ৩শ’ ৯৯ হেক্টর জমির চিংড়ি ঘের, মৎস্য খামার ও পুকুর, ক্ষতির পরিমান ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। গবাদি-পশুর ক্ষতি হয়েছে ১১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। হাঁস-মুরগী মারা ও ভেসে গেছে ৫ হাজার ৮৭৬ টি, যার ক্ষতির পরিমান ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ২০ টাকা। জেলার ১শ’ ২০টি মাদ্রাসা ও মসজিদের আংশিক ক্ষতি হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। জেলা-উপজেলার ৫৫টি কাঁচা ও পাকা সড়কের ক্ষতি ও আংশিক ক্ষতির পরিমান ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এছাড়া, বনাঞ্চল ও নার্সারী ৩.২৫ হেক্টর, যার ক্ষতির পরিমান ৮৭ লাখ টাকা। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা ৬৭টি ক্ষতি ও আংশিক হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। নলকূপ ও স্যানিটেরি ২ হাজার ১০টি ক্সতিগ্রস্থ্য, ক্ষতি প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং কমিউনিটি কিনিক ৮টি ক্ষতিগ্রস্থ্য, যার আনুমানিক ক্ষতির পরিমান ৪ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে, স্থানীয় বাসিন্দারা ও সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বলেশ্বর, সন্ধ্যা, কচাঁ, তালতলা, কালিগঙ্গা, মধুমতি ও পোনা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে ৭ উপজেলায় নারী পুরুষসহ শিশুরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বসবাস করতে হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী ও বুলবুলের আঘাতে বিদ্ধস্থ জনপদে পরিনত হয়েছিল। বলেশ্বর নদের অব্যহত নদী ভাঙ্গন ও বর্ষা মৌসুমে এর তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালে তখন জেলায় প্রাণহানী ঘটে ৬ শতাধীক নারী পুরুষ সহ শিশুর। নিখোঁজের সংখ্যাও কম নয়। নদী তীরের সকল বেড়িবাঁধ বিদ্ধস্থ হয় যায় তখন। তারপর থেকে নামে মাত্র সংস্কার হলেও তা সমস্যার সমাধান করতে পারে নাই। সামান্য জোয়ারে লোকালয় পানিতে প্লাাবিত হয়। ডুবে যায় ফসলের তে। জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসা কচুরিপানা জমে যায় ফসলের েেত। ফসলের মারাত্মক তি করে। ডুবে যায় যাতায়াতের পথ। পানির চাপে ভেঙ্গে যায় বসত ঘরের মাটির তৈরী মেঝে। ভেসে যায় মাছের ঘের। স্কুলগামী শিশু শিার্থীদের বন্ধ হয়ে যায় স্কুলে যাওয়া। মুল বেড়িবাঁধ থেকে নদী প্রায় আধা কিলোমিটার দূরত্বে ছিলো। যা ভেঙে বেড়িবাঁধ ধরে গেছে। লঞ্চঘাট সংলগ্ন বাজার অর্ধেক বিলীনি হয়ে গেছে। এ ভাঙনে বসত ঘর, স্টীমারের যাত্রী ছাউনী, টিকেট বুকিং কাউন্টারসহ বেশ কয়েকটি দোকান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেড়ি বাঁধ সংকটে দিশেহারা স্থানীয়রা। সরেজমিনে দেখা গেছে বিভিন্ন সড়ক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে-বাইরে পড়ে রয়েছে বৃক্ষ। জেলা প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে আরও জানা যায়, জেলার উত্তরের জনপদ নাজিরপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত শ্রোতস্বীনি মধুমতি গ্রাস করেছে মাটিভাঙ্গা ও শ্রীরামকাঠি বন্দরকে। তাছাড়া উপজেলার তালতলা নদীর তীব্র ভাঙ্গনের কবলে হোগলাবুনিয়াসহ আরো অর্ধশত গ্রামের শতাধিক পরিবার।

এদিকে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক সম্প্রতি (২৮.০৫.২০২০) মঠবাড়িয়ার বড়মাছুয়ায় তিগ্রস্থ বাঁধ পরিদর্শন করেছেন এবং তিগ্রস্থ বড়মাছুয়া স্টিমার ঘাট সংলগ্ন ৫০ মিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য জরুরী ভিত্তিতে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্ধের আশ্বাস দেন। এর আগে নদী ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট শ. ম রেজাউল করিম এমপি এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলার ভাঙন কবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক নদী ভাঙনের শিকার নদী তীরবর্তী মানুষের ভোগান্তির কথা শোনেন এবং এসব এলাকায় বাধ নির্মানের আশ্বাস দেন মন্ত্রী। প্রকৃতির অপার লীলাভূমি নৈশ্বর্গীক দৃশ্য সম্বলিত পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর খেয়াঘাট পরিদর্শন করেন। এই নদীর পাড়ে একটি শহর রা বাধ নির্মান করা হবে বলে জানান মন্ত্রী। শহর রক্ষার জন্য এখনই কোন তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবীও। এরপর হুলারহাট বন্দর, কালিগঙ্গা ও সন্ধ্যা নদীর ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর শ্রীরামকাঠিতে ভাঙনে তিগ্রস্থ মানুষের কথা শোনেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং দ্রুত তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। সম্প্রতি শহর রা বাঁধ নির্মানে বলেশ্বর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে ডিসি পার্ক পর্যন্ত ২শ ১৯ কিঃমিঃ ব্লক পাইলিং, যা নির্মাণ ব্যায় ধরা হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নদীর তীর সংরণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস এই প্রতিবেদককে বলেন।

তবে সমস্যা সমাধানে তিগ্রস্থ এলাকাবাসী একথায় আশস্থ হতে রাজি নয়, তাদের দাবী অতিসত্ত্বর উর্ধ্বতন কতৃপ হস্তপে না করলে ভবিষ্যতে জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে অনেক জনপদ, ফলে বাস্তহারা হবে কয়েক হাজার পরিবার। তারা শুধুমাত্র বেড়ীবাঁধের কারনে হারিয়েছে তাদের শ্রমে চাষাবাদকৃত ফসল, ঘের-পুকুরের মাছ এবং সবশেষ আশ্রয়স্থল তাদের ঘরবাড়ী। তারা মনে করে এভাবে তাদের উপর বার বার প্রকৃতিক আঘাত আসলে তারা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারবে না। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব তারা তাদের এলাকার বেড়ীবাঁধগুলো নির্মানের জোর দাবী জানান।
পিরোজপুর জেলার পশ্চিমে সমুদ্র ও মোংলা বন্দর, ষাটগম্বুজ মসজিদ, ইসলামী প্রতœতাত্তিক নিদর্শন খানজাহান আলীর দরগাহ, পূর্ব পাশে শতাব্দীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান ছারছীনা দরবার ছরীফ। সবকিছু ছাড়িয়ে উত্তর পাশে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন ও অপরদিকে, নদী পথে নৌকা ভ্রমনসহ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এখন সারা দেশে পরিচিত। এই জেলায় জন্ম নিয়েছে শের ই-বাংলা একে ফজলুল হক। প্রতিবেশ এই স্মৃতি ধন্য হলেও পিরোজপুর জেলার ভাগ্যে গড়ে ওঠেনি কোন ঐতিহাসিক দৃষ্টিগোচর কাঠামো। কাজ চলছে কঁচা নদীতে ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী বেকুটিয়া সেতু। তাই জেলার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী পিরোজপুরবাসীকে আলোকিত করার জন্য নীমা খালের গোড়া থেকে শুরু করে ডিসি পার্ক পর্যন্ত ৩ কিঃমিঃ শহর রা বাঁধ নির্মান করে নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে শহরকে রা এবং বেড়ি বাঁধ ও ব্লক পাইলিং এর ওপর পাকা সড়ক নির্মান করা হলে সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। নদী পথে নৌকা ভ্রমনসহ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে এ জোর দাবী জানায় সরকারের কাছে স্থানীয় নাগরিকবৃন্দ।

বেড়িবাঁধ নির্মাণে বিষয়ে পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, তিগ্রস্থ বাঁধের তালিকা করে সংশিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিবেন। নদীর তীর ভাঙ্গন রোধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে এর উত্তরে তিনি বলেছেন, মঠবাড়িয়ার বড়মাছুয়া স্টিমারঘাট এলাকায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর তীর সংরণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইন্দুরকানির টগরা গ্রামে সোয়া তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ১ কোটি ৩৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজার, বন্দর, বেড়িবাধ ও নদী ভাঙ্গনের প্রতিবেদন এবং এগুলি রার জন্য প্রস্তাবনা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক আবু আলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেন বলেন এ ব্যাপারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে কোন সহযোগিতা চাইলে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করব। ইতিমধ্যেই জেলার বিভিন্ন্ উপজেলায় জরুরী ভিত্তিতে পূণর্বাসন কাজের জন্য বরাদ্ধ দেয়া শুরু হয়েছে এবং অতি জরুরী কাজ গুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

Comment here