অপরাধ

পিরোজপুরে এহ্সান গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগঃ অর্ধশতাধিক গ্রাহকের সংবাদ সম্মেলন

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
‘এহ্সান গ্রুপ পিরোজপুর বাংলাদেশ’ নামে একটি সমবায় সমিতি ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা এবং অধিক মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে গ্রাহকের লভ্যাংশসহ মূলধন ফেরত না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে দশ হাজার গ্রাহকের ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে প্রষ্ঠিানটির কর্নধার মুফতি রাগীব আহসান এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। এ ব্যাপারে থানা ও আদালতে মামলা দায়ের হলেও তার টিকিটিও স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী ও দুর্বৃত্ত বাহিনির ছত্রছায়ায় থেকে এ হেন প্রতারণা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে জানান ভুক্তভোগীরা।

অনেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার লোভে পড়ে তাদের জীবনের শেষ সম্বল আমানত হারিয়ে এখন পথে বসেছে গ্রাহকরা। আমানতের টাকা ফেরত চাইলে মুফতি রাগীব আহসানের নিজস্ব অস্রধারি বাহিনি দিয়ে তাদের শারীরিক নির্যাতনসহ প্রাণ নাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
টাকা ফেরত পাবার আশায় এবং প্রতারক হেফাজত নেতা মুফতি রাগীব আহসানের বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাতে প্রতারিত অর্ধশত গ্রাহক পিরোজপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা জানান, পিরোজপুর সদরের খলিশাখালী এলাকার আব্দুর রব খানের বড় ছেলে মুফতি রাগীব আহসান ২০১০ সাল থেকে এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামীয় একটি এমএলএম কোম্পানি শুরু করেন। ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ শুরু করেন। এক লাখ টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দিয়ে প্রায় ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। একটি মসজিদে নামমাত্র বেতনে ইমামতি করা রাগীব এর আগে এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি নেন। পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই পিরোজপুরে এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন পরবর্তীতে যা এহ্সান গ্রুপ পিরোজপুর বাংলাদেশ নামে পরিচিতি পায়। এ প্রতিষ্ঠানে টাকা লগ্নি করার জন্য কৌশল হিসেবে প্রতারক মুফতি রাগীব আহসান দেশ বিদেশের কতিপয় ধর্মীয় নেতাদের তার প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে লগ্নি বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহ’র বয়ান দেয়াতেন। শুধু তাই নয় এসব ধর্মীয় নেতারা কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ ধর্মভিরু মানুষকে আামানত রাখার জন্য প্রলুব্দ করতেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানোনো হয়, পিরোজপুর জেলা শহরসহ ও সন্নিহিত কয়েকটি জেলার নামি দামি লোক, রাজনৈতিক নেতা, অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, বিদেশ ফেরৎ, মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছ থেকে এই গ্রুপটি সাত-আট বছর ধরে কোটি কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। ব্যাংকের মতোই ফিক্সড ডিপোজিট এবং ডিপিএস পদ্ধতিতে মানুষকে বড়ো অঙ্কের মুনাফার লোভ দিয়ে টাকা রাখতে উৎসাহ দেয় তারা। লোকজনও লোভের বলি হয়ে সেই ফাঁদে পা দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তারা প্রতি লাখ টাকা বিনিয়োগে মাসিক ২ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দেয়। অথচ এত উচ্চমুনাফা দেশের সরকারি বেসরকারি কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।

পিরোজপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি শপিং কমপ্লেক্সে প্রধান অফিস ও বাইপাস সড়কে শাখা অফিস বসিয়ে এ ব্যবসা চালানো হয়। এহ্সান গ্রুপ তাদের প্রোসপেক্টাসে লিখেছে, তাদের সঞ্চয় ও ঋণদান, ক্যাডেট একাডেমি, কোটি কোটি টাকার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, গার্মেন্টস ও প্রসাধনী ব্যবসা, স্যানিটারী ও হার্ডওয়ার ব্যবসা, মহিলা মাদ্রাসা, ইসলামি রিসার্স সেন্টার ইত্যাদি নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার আটটি চালু রয়েছে এবং এই আমানতের টাকায় পরিচালিত হয়। পরবর্তিতে এহসান গ্রুপের জালিয়াতি ফাঁস এবং গ্রাহকরা লভ্যাংশ সহ মূলধন ফেরত চাইলে নানান টালবাহনা শুরু করে। এসময় প্রভাবশালীদের চাপের মুখে লভ্যাংশ সহ মূলধন ফেরৎ দিলেও সাধারণ গ্রাহকের টাকা আর ফেরৎ দেয়না, শুরু করে নানান টালবাহনা। এক পর্যায়ে ‘এহ্সান গ্রুপ পিরোজপুর বাংলাদেশ’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘এহ্সান পরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিঃ’ নামকরণ করেন মুফতি রাগীব আহসান।

সংবাদ সম্মেলনে, লিখিত বক্তব্যে পিরোজপুর সদর উপজেলা হুলারহাটের মুফতি সহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি ২০১২ সালে সাত বছর মেয়াদে ৭৫ হাজার টাকা আমানত রাখেন। তাকে সাত বছর পর টাকা দ্বিগুন দেয়া হবে। মেয়াদ পূর্ণ হলে তিনি টাকা চাইলে নানান তালবাহানা সহ জীবন নাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। এসময় সদরের দূর্গাপুর এলাকার বাসিন্দা আবু জার মৃধা বলেন, তিনি ২০১৬ সালে বিদেশ থেকে আসলে তাদের এজেন্ট (মাঠ কর্মী) এর খপ্পরে পড়ে ‘এহ্সান গ্রুপে ২০ লাখ আামানত রাখেন। তিনিও কোন টাকা ফেরত পাননি। অধিক মুনাফার প্রলোভনে পড়ে তিনি সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন।

পিরোজপুর শহরের মাছিমপুর বলাকা ক্লাব এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা মো. রফিকুল আলম জানান, দেড় বছর আগে মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার শর্তে ৩ লাখ টাকা এ প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখেছিলেন। এখন আমানতের অর্থ ফেরত চাইলে গড়িমসি করা হচ্ছে। একই অভিযোগ দক্ষিণ কৃষ্ণনগরের কালাম খানের ছেলে রুহুল আমীনেরও। তাকে তিন মাস ধরে কোনো মুনাফা দেওয়া হচ্ছে না। শহরের সিও অফিস এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মনসুর আলী শেখ ও তার বোন রওশন আরা বেগম ২০ লাখ টাকা আমানত রেখেছেন। বতর্মানে তাদেরও কোনো মুনাফা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন।

পিরোজপুর সদর উপজেলার গাজীপুর ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ ফারুক হোসেইন, স্থানীয় মুর্শিদা বেগম, আবুল কালাম, রিনা বেগম, মসজিদের ইমাম রফিক মোল্লাসহ বেশকিছু ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক জানান, শুরুর পর কয়েক বছর ঠিকমত গ্রাহকদের সাথে লেনদেন স্বাভাবিক রাখলেও, প্রায় ২ বছর ধরে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে টালবাহনা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর তাদের অফিসের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি আত্মগোপনে চলে যায় রাগীবসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। আর গ্রাহকরা ঘুরতে থাকেন তাদের দ্বারে দ্বারে। তবে অভিযোগ উঠেছে, এগুলোর অধিকাংশ কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এরকম আরো বহু গ্রাহক জানান, লোভে পড়ে কষ্টের টাকা এখানে জমা রেখে এখন তা ফেরত পেতে জুতার তলা ক্ষয় করে চলেছেন। ‘দিব দিচ্ছি’ বলে কেবলই সময়ক্ষেপণ করছে। তবে নিজেদের গচ্ছিত টাকা না পেয়ে অসহায় মানুষগুলোর মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের জোর দাবি, তাদের গচ্ছিত রাখা টাকা ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনসহ আরো উচ্চ পর্যায়ে যেন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এদিকে এহ্সান গ্রুপের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সমবায় অধিদফতর থেকে নেয়া হয়েছে। সেখানে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে অনিয়ম ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সমবায় অফিসার মো. মুজিবুল হক।

তবে সমবায় দফতর থেকে নেয়া লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে আমানত সংগ্রহ করায় তা গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক আবু আলী মোহাম্মাদ সাজ্জাদ হোসেন। পাশাপাশি জনগণকে তাদের সঙ্গে লেনদেন না করার আহ্বানও জানান তিনি। তবে অভিযোগের বিষয়ে এহসান গ্রুপ কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতারণার অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে এহসান গ্রুপে পিরোজপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি এবং এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি কার্যালয়ে গিয়েও রাগীব আহসানকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফেনো ফোন দিলে তাও বন্ধ পাওয়া যায়।

জানা যায়, পিরোজপুরে এহ্সান গ্রুপের কর্ণধার মুফতি রাগিব হাসানের ১১ কোটি টাকার চেক জালিয়াতী মামলায় (‘সিআর ১২২/১৯) জেল হাজতে যাবার ঘটনা জানতে পারার পরপরই এহ্সান গ্রুপ এর গ্রাহকদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
হায় হায় কোম্পানি খ্যাত প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি, যুবক, পে-টু ইউ, ডোলেঞ্চার, বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির পথেই কি যাচ্ছে পিরোজপুরের এহ্সান গ্রুপ এমন ধারনা জন্মেছে গ্রাহকদের মাঝে। সচেতন মহল মনে করেন, ‘প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎকারী এই চক্রের শেকড় অনেক গভীরে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া না হলে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

Comment here