ব্রেকিং নিউজ

ডিসি অফিসে সাংবাদিক আরিফকে উলঙ্গ করে চোখ বেঁধে নির্যাতন

অনলাইন ডেস্কঃ
পুলিশ ছাড়া আনসার নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দরজা ভেঙে আরিফুলের বাসায় ঢোকেন৷ এরপর তাকে মারধর শুরু করেন৷ পরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে ‘বিবস্ত্র’ করে নির্যাতন করা হয়৷ তার ভিডিও ধারণ করা হয়েছে৷ শুক্রবার রাতে কুড়িগ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে৷
অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে শুক্রবার (১৩ মার্চ) গভীর রাতে বাসার গেট ও ঘরের দরজা ভেঙে ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন। তাকে মারধর করতে করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তার পোশাক খুলে দুই চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। পুরো দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে। আর এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন। এমনটাই অভিযোগ করেন তার স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতু। শনিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে কুড়িগ্রাম কারাগারে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের সঙ্গে তার স্ত্রী দেখা করতে গেলে তিনি এসব তথ্য জানান।
আরিফুল ইসলাম স্ত্রীকে জানান, মধ্যরাতে তাকে বাসা থেকে জোর করে তুলে আনার পথে জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত লাথি-থাপ্পড়, ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তার দুই চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর প্যান্ট ও গেঞ্জি খুলে তাকে উলঙ্গ করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
এসব দৃশ্য ভিডিও করা হয় বলে জানিয়েছেন আরিফুল। তিনি আরও জানান, যারা তাকে নির্যাতন করেছে, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা। তাদের দেখতে না পারলেও তাদের সবার গলার স্বর তার মনে আছে।
আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতু বলেন, ‘‘কেন আমার স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে আমরা জানি না৷ দরজা ভেঙে ৭/৮ জন বাসায় ঢোকে৷ এরপরই পেটাতে শুরু করে৷ কী অপরাধ জানতে চাইলে আরো বেশি মারতে থাকে৷ এক পর্যায়ে টিনের বেড়া ভেঙে ওকে নিয়ে যায়৷ প্রথমে তো আমরা জানতামই না, কারা নিয়ে গেছে? ধরার সময় শুধু বলেছে, তুই অনেক জ্বালাইছিস৷ পরে আমি কারাগারে দেখা করি৷ তখন সে দাঁড়াতেই পারছিল না৷ আমাকে বলল, বিবস্ত্র করে পিটিয়েছে৷ দুটি কাগজেও স্বাক্ষর নিয়েছে৷’’
আরিফুলকে আটক অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা৷
তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘অভিযানের সময় তার কাছ থেকে আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে৷ এই অপরাধ তিনি স্বীকার করায় তার এক বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷” তবে আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘বাসাতে তারা কোন তল্লাশি করেনি৷’’
মোস্তারিমা সরদার নিতু আরও জানান, ‘আমার স্বামী খুবই অসুস্থ। সে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। আমাদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার মতো শক্তি ছিল না তার।’
তিনি আরও জানান, ‘শুক্রবার রাতের অভিযানে আরডিসি নাজিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। তাকে চিনতে পেরে সকাল ১০টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করি। ওই সময় ওই কর্মকর্তা আমাকে জানান, আমার স্বামী মাদকসেবী, এটা তাদের কাছে প্রমাণ আছে। আমি এর প্রমাণ দাবি করলে তিনি তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে চলে যান।’তবে আরডিসি নাজিম উদ্দিন অভিযানে থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি গতরাতে ওয়ার্ক স্টেশনে ছিলাম না।’

কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও একুশে টেলিভিশনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আতাউর রহমান বিপ্লব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত বছরের মাঝামাঝি আরিফুল একটা রিপোর্ট করেছিলেন, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন৷ ওই সংবাদের পর তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি৷ এছাড়া সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন আরিফ৷ এ বিষয়ে জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়৷ এসব কারণে ডিসি তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন৷ আর তার বিরুদ্ধে মাদকের যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা আদৌ সত্যি নয়৷ আরিফুল মদ বা গাঁজা তো দূরে থাক সিগারেটও খান না৷ শুধুমাত্র প্রতিহিংসার কারণেই তাকে মধ্যরাতে গ্রেফতার ও সাজা দেওয়া হয়েছে ৷ আমরা বলেছি, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে না দিলে কঠোর আন্দালন গড়ে তোলা হবে৷’’
শনিবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সাংবাদিক মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়৷ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘‘আরিফুলের ওপর যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে৷ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়৷ মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট ও সাজা কোনও কিছুই আইনসম্মত নয়৷ ডিসি বলেই সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়৷’’
এরপরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ শনিবারই কমিটির সদস্যরা আরিফুলের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন৷
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আধা বোতল মদ আর দেড়শ গ্রাম গাঁজার জন্য মধ্যরাতে যেভাবে অভিযান চালানো হয়েছে তা অস্বাভাবিক৷ যেহেতু আরিফুলের কাছে ক্ষতিকর কিছু ছিল না, তাহলে ভোর পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট অপেক্ষা করতে পারত৷ কিন্তু তারা যেভাবে ধরে ডিসি অফিসে নিয়ে সাজা দিয়েছে তা স্বাভাবিক নয়৷ এখানে অবশ্যই আইনের ব্যত্যয় হয়েছে৷’’
ঘটনার পর থেকে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷ তবে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘গ্যাপ’ থাকলে দেখা হবে৷ টাস্কফোর্সের অভিযান ছিল৷ এটা ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করেছে রেগুলার শিডিউলের অধীনে৷ সঙ্গে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের লোক, পুলিশ, আনসার ছিল৷’’
পুকুর নিজের নামে নামকরণ করা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আরিফুলের বিরুদ্ধে এরকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো এক বছর আগের ঘটনা৷ আর রিপোর্টটিও মিথ্যা৷ এরকম কিছু হলে তো তখনই হতো৷ আর এই রিপোর্টের জন্য তো সে স্যরি বলেছে৷ আমরা ভিনডিকটিভ (প্রতিহিংসাপরায়ণ) না৷’’
তবে জেলা প্রশাসকের এই বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি৷ পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই অভিযানের সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই৷ পুলিশ জানিয়েছেন, এই অভিযানে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না৷
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘ইতোমধ্যে একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার কুড়িগ্রামে চলে গেছেন বিষয়টি তদন্ত করতে৷ অবশ্যই টাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার একটি টাইম ফ্রেম দেওয়া আছে৷ সেটি অমান্য করা সরকার ও প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর৷’’
উল্লেখ্য, শুক্রবার (১৩ মার্চ) মধ্যরাতে বাড়িতে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। মধ্যরাতে ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে দরজা ভেঙে তার বাসায় প্রবেশ করেন। তবে তারা কোনও তল্লাশি অভিযান চালাননি। পরে ডিসি অফিসে নেওয়ার পর তারা দাবি করেন, আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি।
এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফ। এ বিষয়ে জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়। তবে এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

Comment here