শিল্প ও বাণিজ্য

স্বরূপকাঠির ডকইয়ার্ড দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনাময় শিল্পে রূপ নিচ্ছেঃ তৈরী হচ্ছে বড় কোষ্টারও

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
গত শতাব্দী জুড়ে সুন্দরবনের কাঠ ব্যবসাকে ভিত্তি করে দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠা নৌ-পরিবহন নেটওয়ার্কের প্রধান কেন্দ্র ছিল পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি। এ নেটওয়ার্কের কারণে স্বরূপকাঠিতে দেশীয় কাঠের যে নৌকা নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটে তার দীর্ঘকালীন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বর্তমান রূপ নিচ্ছে এখানকার লৌহজাত নৌ-যান শিল্প ডকইয়ার্ডে।
ব্যক্তি মালিকানায় স্থাপিত স্বরূপকাঠির প্রায় এক ডজনের বেশী ডকইয়ার্ডে এখন ইস্পাত নির্মিত ছোট ছোট লঞ্চ, কার্গো, মিনি ড্রেজার, ট্রলার ইত্যাদি তৈরী বা মেরামতের পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে বৃহদাকারের কোষ্টারও। সাশ্রয়ী ব্যয়, মানসম্মত নির্মাণ এবং চাহিদা মাফিক সরবরাহের নিশ্চয়তা পেতে নৌ-যান নির্মাতা বা মেরামত ইচ্ছুক অনেকে সূদুর ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরের ডকইয়ার্ডের চেয়ে স্বরূপকাঠির ডকইয়ার্ডকে পছন্দ করছে। প্রায় দুই যুগ ধরে এখানে বিকাশমান ডকইয়ার্ড শিল্প ক্রমান্বয়ে নৌ-যান মালিকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে। স¤প্রতি দেখা গেছে এখানকার সোহাগদল গ্রামের একটি ডকইয়ার্ডে ৫০০ টন ধারণ ক্ষশতা সম্পন্ন ১৩০ ফুট দীর্ঘ ও ২৮ ফুট চওড়া বিরাট মালবাহী কোষ্টারও তৈরী করা হচ্ছে। এ ডকইয়ার্ড প্রমাণ করেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, কালিগঞ্জ, ফতুল্লা বা চট্টগ্রামের কোন ডকইয়াডের্র তুলনায় তারা পিছিয়ে নেই। উপরন্তু তাদের সেবা অনেক উন্নত ও মানসম্মত।
প্রথমবার কেউ পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায় এলে একটু অবাকই হবেন। এ উপজেলার নদীর পাড়ে বিভিন্ন স্থানে দেখা যাবে নানা আকৃতির ছোট-বড় জাহাজ। কোনোটি পূর্ণাঙ্গ, আবার কোনোটি তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। একটি উপজেলার নানা স্থানে তৈরি হচ্ছে নতুন জাহাজ- এ দৃশ্য অবাক করার মতোই। স্বরূপকাঠী বাণিজ্যসমৃদ্ধ একটি উপজেলা। কাঠ ব্যবসার জন্য দেশের মানুষের কাছে পরিচিত এই স্বরূপকাঠী। বর্তমানে এ উপজেলার বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে আধুনিক মানের জাহাজ। এসব ডকইয়ার্ডে জাহাজ তৈরির পাশাপাশি মেরামতও হচ্ছে। জানা যায়, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী একটি নদীবেষ্টিত বাণিজ্যসমৃদ্ধ এলাকা। পেয়ারা, কাঠ ব্যবসা ও নার্সারির জন্য বিখ্যাত স্বরূপকাঠী। নদী-খালবেষ্টিত হওয়ায় এসব পণ্য পরিবহনে প্রাচীনকাল থেকে স্থানীয়রা নৌকার ওপর নির্ভরশীল। ধীরে ধীরে কাঠের নৌকার পাশাপাশি ইঞ্জিনচালিত স্টিলের ট্রলার ব্যবহার শুরু হয় এখানে। এসব ট্রলার মেরামত ও তৈরির জন্য গড়ে ওঠে ডকইয়ার্ড। সময়ের ব্যবধানে এসব ডকইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে ছোট-বড় নানা আকৃতির জাহাজ। বানানো হচ্ছে লঞ্চ, উন্নত মানের ট্রলারসহ নানা নৌযান। এখানকার ডকইয়ার্ডে উপজেলার বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি এটি রূপ নিয়েছে সম্ভাবনাময় শিল্পে। স্বরূপকাঠীর বুক দিয়ে প্রবাহিত সন্ধ্যা নদীর তীর আর সোহাগদল, কালিবাড়ী, বরইকাঠী, বালিহারী, তারাবুনিয়ার খালের তীরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ১৫টির মতো ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণের বিভিন্ন ধাপ সেটিং, কাটিং, ওয়েডিং, রঙের কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব ডকইয়ার্ডে এক টন থেকে শুরু করে এক হাজার টন ধারণক্ষমতার কার্গো জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব জাহাজের কোনোটির দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট পর্যন্ত। স্বরূপকাঠীর ডকইয়ার্ড নির্মাণ ঠিকাদার এবং এখানে তৈরি জাহাজ-মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব ডকইয়ার্ডে এক হাজার টন ধারণক্ষমতার বড় জাহাজ তৈরি করতে সময় লাগে ছয় থেকে সাত মাস। আর একটি জাহাজ তৈরি করে ঠিকাদারদের লাভ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। স্বরূপকাঠীর ডকইয়ার্ড থেকে জাহাজ তৈরি করে সন্তুষ্ট মালিকরা। তাদের দাবি, ঢাকা বা অন্যান্য ডকইয়ার্ডে নির্মাণ না করে এখান থেকে একটি বড় জাহাজ নির্মাণ করলে তাদের ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়। উপজেলার এসব ডকইয়ার্ডে কাজ করা শ্রমিকদের প্রতিদিন বেতন প্রকারভেদে ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ডকইয়ার্ড মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৪০ বছর আগ থেকে এ উপজেলায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয়। আগে বিষয়টি জেলার বাইরে তেমন কেউ না জানলেও বর্তমানে এখানে মানসম্পন্ন বড় জাহাজ তৈরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে জাহাজ-মালিকরা তাদের নৌযান নির্মাণ ও মেরামত করতে আসছেন। জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে ওয়ার্কশপ, হার্ডওয়ার, স্টিলপ্লেট, ওয়েল্ডিং রড ও রঙের কারখানাসহ নানা ধরনের ছোট-বড় শিল্প। বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এসব কারখানায়। ডকইয়ার্ড মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল আনা হয় ঢাকার পোস্তগোলা, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী, কুমিরা, সীতাকুণ্ড থেকে। এ ছাড়া কিছু কাঁচামাল বিদেশ থেকেও আমদানি করা হয়ে থাকে।
ডকইয়ার্ড মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান জানান, এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানকার সম্ভাবনাময় জাহাজ নির্মাণ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। স্বরূপকাঠী থানার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল কালাম তালুকদার জানান, এখানকার জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এখানে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তবে এ উন্নতি কাক্সিক্ষত মাত্রার নয়। এখানে আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা ব্যক্তি পর‌্যায়ে সম্ভব নয়। সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা হলে এ শিল্প আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।

Comment here