আহাদ শিমুল:
পিরোজপুরের ইন্দুরকানী বাজারের পল্লী চিকিৎসক সুনীল চন্দ্র দাসের (৬৬) মরদেহ ইন্দুরকানীতে যখন পৌঁছায় তখন রাত ১ টা। তার শেষকৃত্য করার মত তখন কেউ নেই।
এম্বুলেন্স থেকে শ্মশানে নেয়ার মত কাউকে আর পাওয়া গেল না।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পিরোজপুরের পুলিশ সুপার হায়াতুল ইসলাম খানের নির্দেশে ছুটে আসলেন ইন্দুরকানী থানার ওসি হাবিবুর রহমান। সাথে পুলিশের সাহসী একটি দল।
তারা পল্লী চিকিৎসক সুনীলকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন।
সারা রাতে থেমে থেমে বৃষ্টি চলেছে। সেউতিবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়ির শ্বশানে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোন আপনজনের দেখা নেই। আপনজন বলতে মৃতের শোকাহত স্ত্রীসহ দু একজন নারী ও সদ্য প্রয়াত ভাইয়ের ছোট ছেলে। তারাও বাগানের মধ্যে দূরে দাড়িয়ে। এরই মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ওসির নেতৃত্বে এসআই ফরিদ, শহিদুল, মনমথ, এএসআই শাহাদত, হাসপাতালের গাড়ী চালক ইকরামুল ও সুনীলের ভাতিজা শুভসহ পুলিশ সদস্যরা মাটি খোঁড়ার আয়োজন করেন। এসময় কয়েকটি মোবাইলের আলো ও একটি টর্চ লাইটই ছিল এক মাত্র আলোর ভরসা।
কিন্তু কোদাল খোন্তা কই পাবেন? ওসি নিজে বেশ কয়েকটি ঘরের দরজায় কড়া নারেন একটু আলোর ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। অনেক কষ্টে মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন তারা। এরপরে পুলিশ সদস্য ও গাড়ি চালক মিলে মাটি খুঁড়ে সমাধি তৈরী করেন। আর তারাই সমাধিস্থ করেন এই পল্লী চিকিৎসককে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাকে শেষ বিদায় জানান পুলিশ সদস্যরা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে সুনীল চন্দ্র যখন পিরোজপুর জেলা শহরের আম্বিয়া হাসপাতালে যান তখন তিনি নিজেই হেঁটে দোতলায় ওঠেন। কিন্তু ঐ হাসপাতালে কোনো লোকজন না দেখে তার পরিবারের লোকজন সিভিল সার্জনকে ফোনে জানালে একজন নার্স এসে সুনীলকে অক্সিজেন দেয়ার সাথে সাথে তিনি মারা যান। পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়। সুনীলকে যে এম্বুলেন্স আনা হয়েছিল সেই এম্বুলেন্স হাসপাতালের সামনে দাড়াতে দেয়নি স্থানীয়রা বলে অভিযোগ করেন গাড়ী চালক নাসির উদ্দিন। তাই গাড়ী নিয়ে সদর হাসপাতালে চলে যান তিনি। সুনীলের মরদেহ নিয়ে তার পরিবারের লোকজন পড়েন মহা বিপদে। তারা যোগাযোগ করেন পিরোজপুরের এক নারী নেত্রীর সাথে। তিনি উপরস্থ কর্মকর্তাদের বিপদগ্রস্থ পরিবারটির পাশে দাড়াতে অনুরোধ করেন। সিভিল সার্জন এম্বুলেন্স পাঠান। কিন্তু সুনীলের মরদেহ কে তুলে দেবে এম্বুলেন্সে ?
ওই নারী নেত্রী জানান, সুনীলের স্ত্রী ও ভাবীর মরদেহ গাড়িতে তুলতে কাউকে না পেয়ে আমাকে ফোন করে সাহায্য চায়। তারা আমাকে ফোন করে বলেন, দেখেন টাকা দিয়েও যদি হয় কাউকে একটু পাঠিয়ে দিন। কিন্তু কাউকে পেলাম না। আমারা প্রশাসনকে জানালাম। তারা আশ্বাস দিলেন। কিন্তু কেউ যাচ্ছে না দেখলে ওই দুই মহিলা আর ভাইর ছেলে মরদেহকে টেনে টেনে দোতলা থেকে নামিয়ে এনে ড্রাইভের সহায়তায় এম্বুলেন্সে উঠিয়ে ইন্দুরকানী নিয়ে যায়।
গত বৃহস্পতিবার করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান ইন্দুরকানী বাজারের পল্লী চিকিৎসক সুনীলের ছোট ভাই নির্মল চন্দ্র দাস (৬১)। এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন নির্মলের বড় ভাই সুনীল চন্দ্র দাস (৬৬)। তারা দুজনই পল্লী চিকিৎসক।
গতকাল মঙ্গলবার তার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। তাই তাকে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তি দেখিয়ে তাকে পাঠানো হয় আম্বিয়া হাসপাতালে।
ইন্দুরকানী থানার ওসি হাবিবুর রহমান জানান, একটা সময় রাত বিরাতে অসুস্থ রোগীদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন অহি ভূষন ও তার দুই ছেলে সুনীল এবং নির্মল। ইন্দুরকানীর পল্লী চিকিৎসায় তাদের পরিবারের অবদান অনেক। অন্তত ৯০ বছর ধরে তারা এই এলাকার রোগীদের সেবা দিয়েছেন। কিন্তু সেই সুনীল ডাক্তারের শেষ বিদায়ের সময় কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। আশপাশের লোকদের অনেক ডেকেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনকি একটি মাটি খোঁড়ার কোদাল চেয়েও পাই নাই। সারারাত ভিজে সুনিল চন্দ্রকে এম্বুলেন্স থেকে সমাধিস্থ করা পর্যন্ত সব কাজ আমরা করি। ঘরে ফিরতে ফিরতে মসজিদের মাইকে তখন আজানের সুর ধ্বনিত হয়। এর মাঝে বৃষ্টি চলতে থাকে। আকাশটাও হয় তো এমন বিদায়ের অশ্রু ভার সহ্য করতে পারেনি। তাই পৃথিবীর মানুষ নামের অমানুষদের নিজ অশ্রু জলে ভিজিয়ে মানবিক হওয়ার আহবান জানিয়ে দিল। আর মাঝে মাঝে গর্জে উঠে বলে গেল ‘এবার তোরা মানুষ হ’।
Comment here