শিল্প ও বাণিজ্য

দেশের ৭০ ভাগ ক্রিকেট ব্যাট তৈরি হয় পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
অজপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রামের নাম বিন্না। গ্রামটিকে এখন সবাই চেনে ‘ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত এ জনপদ বিন্না। আধুনিকতার কোন ছাঁপ পড়েনি এখনও এই জনপদে। তবুও বসে নেই এখানের সংগ্রামী নারী-পুরুষ। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া তেমন না লাগলেও এ গ্রামকে অনেকেই চেনেন ‘ব্যাট কালামের’ গ্রাম হিসেবেও। আর ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এ অঞ্চলের হাজারও মানুষের।

দীর্ঘ কয়েক যুগ থেকেই কাঠ ব্যবসা সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিত স্বরূপকাঠির ইন্দেরহাটসহ বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া, পঞ্চবটি ও বলদিয়াসহ অন্তত আরও পনেরটি গ্রাম। আর এসব নিভৃত গ্রামেই গড়ে ওঠেছে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। বর্তমানে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিকেরও বেশী। ফরে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে শত শত ব্যাট তৈরী করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সরঞ্জামাদির দোকানে। যেখান থেকে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ তৈরী ব্যাটের চাহিদা পূরণ হয়।

স্বরূপকাঠি অঞ্চল থেকে এমন আশার বাণী শুনিয়েছেন এখানের ব্যাট তৈরীর কারিগররা। দেশের যে হাজার হাজার দেশীয় ব্যাটের ব্যবহার হয় তার জনক হচ্ছেন নেছারাবাদের বেলুয়া নদের তীরে অবস্থিত উড়িবুনিয়ার অখ্যাত ছুঁতোর পরিবারে জন্ম নেয়া অতি দরিদ্র মৃত আব্দুল লতিফ মিয়া। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে কাঠ মিস্ত্রী হিসেবে জুরাইনের ‘খেলার সাথী’ নামে একটি কাঠের কারখানায় কাজ পান। আর সেখান থেকেই বিভিন্ন খেলার সামগ্রী যেমন -প্রাইজ শিল্ড, ক্রিকেট ব্যাট, ক্যারম বোর্ড ও হকি ষ্টীক মেরামতের কাজ রপ্ত করেন। এরপর থেকেই লতিফের মাথায় চেপে বসে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির নেশা।

বিদেশী ব্যাট তৈরীর সমমানের স্থানীয় গাছের সন্ধান করতে থাকেন তিনি। খুঁজে বের করেন দেবদারু, কদম ও বাইনসহ নানা প্রজাতির কাঠ দিয়ে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরীর কাজ। সস্তায় ব্যাট তৈরীর টার্গেট নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে। নিজ বাড়ীতে গড়ে তোলেন ব্যাট তৈরীর কারখান। ঢাকার বাইরে নেছারাবাদে এটাই ব্যাট তৈরীর আদি কারখানা। লতিফ মিয়া কারখানাকে ভিত্তি করে ঢাকায় আমদানীকৃত ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি দোকানে স্থান পায় নেছারাবাদের ক্রিকেট ব্যাট। এভাবেই রপ্তানী সুবিধা বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে ব্যাটের কারখানা। লতিফের সহকর্মী কালাম নিজ বাড়ীতে যে বিরাট কারখানা তৈরী করেছেন তার সৌরভ ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে।
এদিকে, গত কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে স্থানীয় তৈরী ব্যাট স্থানীয়ভাবে বেচা-কেনার। ব্যাটের কারিগররা প্রাথমিকভাবে গাছ চেরাই করে ব্যাট উৎপাদন করলেও সেগুলোকে পরবর্তীতে ঢাকায় প্রেরন করা হত। সেখানেই ঘসামাজা ও বার্নিস এবং লেবেল লাগিয়ে বিক্রয় করা হত। কিন্তু বর্তমানে সেই কাজ গ্রামে বসেই করছে আর এক পর্যায়ের ব্যাট ব্যাবসায়ীরা। পরে সেই ব্যাটগুলোকেই ঢাকাসহ পিরোজপুর ও বরিশাল-খুলনায় বিক্রয়ের জন্য পাঠানো হচ্ছে।

উৎপাদনকারী স্থানীয় ব্যাট কারিগররা জানান, প্রকারভেদে বিভিন্ন গাছের ব্যাট নীচে ৭৫ টাকা থেকে উপরে ১৫০ টাকায় বিক্রয় করছে ঢাকায়। অপরদিকে, ঘসামাজা ও লেবেল লাগানো প্রতিটি ব্যাট পাইকারী রেটে ঢাকায় বিক্রয় করা হয় ছোট নীচে ৩ শত থেকে উপরে ৬ শত৫০ টাকা থেকে ৭ শত টাকা এবং বড় ৮শ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।
স্বরূপকাঠির ব্যাট শিল্প এবং অত্র শিল্পের কারিগরদেরকে স্বীয় পেশায় টিকিয়ে রাখতে হলে এ খাতে পর্যাপ্ত ঋন সুবিধাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কাচাঁ মালের মূল্য কমানোসহ যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন হলে পেশার মান উন্নত ও ব্যাবসায়ীরা লাভের মুখ দেখত বলে মনে করছেন তারা।

Comment here