কাউখালীবিশেষ প্রতিবেদন

দু’শ বছরের ঐতিহ্যঃ নানা সঙ্কটের মাঝেও টিকে আছে কাউখালীর শোলা শিল্প

বিশেষ প্রতিনিধিঃ
নানা সঙ্কটের মাঝেও টিকে আছে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার আমরাজুরী ইউনিয়নের কুমিয়ান গ্রামের শোলা শিল্প। কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও প্রায় ২শ’ বছর ধরে টিকে থাকা শোলা শিল্প কাউখালী জনপদের ঐতিহ্যের অংশ। হিন্দু জনগোষ্ঠীর স্থানীয় মালি সম্প্রদায় শোলা দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। আগের তুলনায় শোলার তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা থাকায় দেশ ও বিদেশে বাজারজাত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানা গেছে, কাউখালীর কুমিয়ান গ্রামে গড়ে ওঠা মালি সম্প্রদায়ের শোলা শিল্প ২০০ বছরেরও বেশি দিনের পুরনো এক শিল্প। এ শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ কোনোমতে টিকে আছে। স্বাধীনতার পূর্বে কুমিয়ান গ্রামে ৩০-৪০টি মালি সম্প্রদায়ের পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ২০-২৫টি মালি পরিবার ভারতে চলে গেলে এ শিল্প কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমানে কুমিয়ান গ্রামে ২০টি পরিবার এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে কাউখালীর শোলা শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এ গ্রামের মালি সম্প্রদায় শোলা দিয়ে ফুল, মুকুটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে তাদের পেশা ধরে রেখেছে। শোলা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মালি সম্প্রদায়ের নারীদের ভূমিকাই বেশি।
এ গ্রামের মালতি মালি (৪৮) বলেন, এককালে এ শিল্পীদের বেশ কদর ছিল। নানান লোকজন বিভিন্ন কারুকার্যের মুকুট এবং পূজার ফুল কিনে নিত। বকশিশ হিসেবেও অনেক অর্থ পাওয়া যেত। তা দিয়ে মালিদের সংসার ভালোই চলত। জমিদার হিন্দুরা চলে যাওয়ায় মালি শিল্পীদের ভাগ্যে জুটেছে হতাশা। এ কারণে অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
জানা গেছে, এখানে শোলা দিয়ে তৈরি হয় দুর্গাপূজার ফুল, ল²ীপূজার ফুল, মনসাপূজার ফুল, কালীপূজার ফুল, বর-করেন বিয়ের মুকুট, নববর্ষের ফুল, জন্মদিনের ফুল, বিবাহবার্ষিকীর ফুল, জামাইষষ্ঠীর ফুল, নতুন গৃহে প্রবেশ করার ফুল, নারায়ণ পূজার ফুলসহ বিভিন্ন হিন্দুধর্মীয় পবিত্র অনুষ্ঠানের ফুলসহ শোভনীয় সামগ্রী।
মালিরা জানান, বিলে এক ধরনের গাছ জন্মে, ওই গাছ কেটে রোদে শুকিয়ে নিলে তৈরি হয় হালকা ওজনের শোলা। এ শোলায় রং দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির ড্যাপ তৈরি করা হয়। তারপর গাম দিয়ে একটার পর একটা জোড়া লাগিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন জিনিস। এরপর তা বাজারজাত করা হয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে এসব বাহারি ফুলের চাহিদা বেশি। একটি ল²ীপূজার ফুল ৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা এবং দুর্গাপূজার ফুল ৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়। নববর্ষের ফুল ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা, বিয়ের মুকুট ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়ে থাকে। আবার অর্ডার দিয়ে প্রয়োজনমতো ফুল তৈরি করিয়েও নেন অনেকে।
কুমিয়ান গ্রামের শোলা শিল্পী মমতা মালী (৩৫) জানান, শোলার ফুল তৈরি করে মাসে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হয়। এত অল্প আয়ে মালিদের সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। তবুও মালীরা তাদের বংশানুক্রমিক পেশা শোলা শিল্প ধরে রেখেছেন। একদিকে অর্থসঙ্কট অন্যদিকে শোলা গাছ কমে যাওয়ায় এ শিল্পে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
কাউখালীর কুমিয়ান গ্রামের মালিদের তৈরি শোলার বিভিন্ন সামগ্রী বরিশাল, ঝালকাঠী, পটুয়াখালী, যশোর, বাগেরহাট ও খুলনায় বাজারজাত হয়। অনেক ব্যবসায়ী অর্ডার দিয়ে শোলার তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে যান। বিশেষ করে জন্মদিনের উৎসব, বিবাহবার্ষিকী, নববর্ষ, চৈত্রসংক্রান্তি, অন্নপ্রাসন অনুষ্ঠানে অর্ডার দিয়ে পণ্য তৈরি করা হয়।
শোলা শিল্পী রণজিৎ মালাকার (৪৫) জানান, তাদের তৈরি দ্রব্য দেশের বাইরেও চালান দেয়া হয়। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প আরও বড় ধরনের লাভজনক শিল্পে পরিণত করা যেত।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক ও সংস্কৃতিজন সুব্রত রায় বলেন, ২০০ বছরের পুরনো এ শিল্প নানা সঙ্কটে পড়ে এখন ক্রমশ বিপন্নতার দিকে। তবে শোলা শিল্প আমাদের ঐতিহ্য হিসেবেই এ জনপদে পরিচিত।
কাউখালী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ও কাউখালী ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংগ্রাহক সমাজসেবক আব্দুল লতিফ খসরু বলেন, কাউখালী জনপদে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য শিল্প আছে তার মধ্যে অন্যতম কুমিয়ান গ্রামের শোলা শিল্প। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলেই এ শিল্পে এখন দৈন্যদশা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সহায়তা পেলে শোলা শিল্প সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে উঠে দাঁড়াতে পারবে।

Comment here