সম্পাদকীয়

কোরবানির মাধ্যমে বিলুপ্ত হোক হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্রোধ

ইসলাম ধর্মের দুই প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল-উল-ফিতর ও ঈদুল-উল-আযহা। এদেশে প্রতিটি মানুষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো আনন্দ-বেদনায় পালন করে। আনন্দের সাথে বেদনা শব্দটি যোগ করার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থেকে সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। উৎসব ও আনন্দের একটি কালো দিক হচ্ছে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি। বর্তমানে সরকার বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে এসব মানব বিরোধী কর্মকা- নস্যাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের জীবনে দুটো প্রবৃত্তি রয়েছে- একটি পশুবৃত্তি ও অন্যটি বুদ্ধিবৃত্তি। পশুবৃত্তিকে দমন করে বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ যখন জীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুপথে পরিচালিত করে তখনই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আদর্শ ও ন্যায়জীবন প্রতিষ্ঠায় মানুষকে লোভনীয় অনেক কিছু ত্যাগ ও বিসর্জন দিতে হয়।
এই ত্যাগ, উৎসর্গ ও কোরবানি হচ্ছে পশুবৃত্তির বিসর্জন। কুরবানির মাধ্যমে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও আনত্মরিকতার উন্মেষ ঘটবে।
বিলুপ্ত হবে সব ধরণের হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্রোধ। কুরবানির মাধ্যমে আলস্নাহর নৈকট্য ও সনত্মুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। কুরবানির মধ্যে দিয়ে মহান আলস্নাহর প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা হয়।
কোরবানির পশু ক্রয়ের সাথে দেশের অর্থনীতির চাকা সম্পৃক্ত থাকে। আমাদের দেশের চামড়া শিল্প মূলত কোরবানির পশুর চামড়ার ওপর নির্ভর করে। পশুর হাটে আনা অবধি মাঠে-ঘাটে চাঁদাবাজি চলে। সকল ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করলেও প্রতি বছর একই চিত্র ঘটতে থাকে।
তাছাড়া ড়্গতিকর ঔষুধ খাওয়ানোর ফলে অনেক পশুর মৃত্যুর খবর শোনা যায়। মোটা তাজা করার জন্য পশুকে ওষুধ খাওয়ানোর ফলে পশুগুলো আকারে বড় হলেও প্রকৃত পড়্গে স্বাস’্যসম্মত থাকে না। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় নিরীহ পশুগুলোর উপর অত্যাচার করা হয়।
পশুর চামড়ার সঠিক সংরড়্গণ ও বিক্রয় দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ নিয়েও চলে নানা প্রকার প্রচার-প্রচারণা।
বিশেষ করে ঈদের দিনে যেখানে সেখানে কোরবানির পশু জবাই না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। যেখানে- সেখানে কোরবানির পশু জবাই করলে যেমন পরিবেশ নষ্ট হয়, তেমনি যেখানে-সেখানে কোরবানির পশুর হাট বসালেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকে ঈদুল আযহার গুরম্নত্ব অসীম।
বর্তমান বাংলাদেশে যে হারে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ও প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা মানুষের মাঝে নিহিত পশুবৃত্তির বহিপ্রকাশ। তাই কোরবানির আদর্শগত শিড়্গা গ্রহণ করে পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধুমাত্র ‘‘আমি ও আমার মঙ্গল নয়, বরং আমাদের সকলের মঙ্গল’’ এমন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ঈদুল আযহার কোরবানির আসল উদ্দেশ্য ।
ঈদ মানেই আনন্দ। আনন্দ মানেই টিকেট, টিকেট মানেই সোনার হরিণ, অবশেষে অনিশ্চিত যাত্রা। ঈদ উদযাপনের একটি দিক হচ্ছে টিকেট প্রাপ্তি, যারা নাড়ির টানে ও শিকড়ের সংস্পর্শে ছুটে যায় তাদের কাছে টিকেট একটি সোনার হরিণের মত। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা উভয়টিতে একটি টিকেটের জন্য অনেক অপেড়্গা ও ধৈর্য্যের পরীড়্গা দিতে হয়। স্বাভাবিক অবস’ায় যে ভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, ঈদ যাত্রায় তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
ঈদ মানে নতুন সাজে নিজেকে সাজানো। আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশ নিম্ন-আয়ের মানুষ। এই বিরাট অংশের আরো একটি অংশ বিভিন্ন পোশাক-শিল্পে চাকুরিরত। সারা বছর বিভিন্ন পোশাক শিল্পে কর্মরত এই মানুষগুলো খেটে চলে। তেমন ছুটি-ছাটা পায় না।
ঈদের এক দুইদিন আগে ছুটি পায়। তখন তারা দলবেঁধে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে চলে, তখনি সড়কপথে বেশি চাপ পড়ে।
এখানে উলেস্নখ্য, যারা সারাবছর পরিশ্রম করে পোষাক শিল্পগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের ন্যায্য বেতন ও বোনাসের জন্যে তাদের ঈদের আগে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। তবে ইদানিং এ অবস’ার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। সরকার ও বিজেএমইএর ভূমিকার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।
এই ধরণের পরিসি’তি প্রতিটি ঈদের আগে ঘটতে দেখা যায়। অন্যান্য পেশার ড়্গেত্রেও বেতন, বোনাস নিয়ে মালিকপড়্গ ও শ্রমিকপড়্গের মধ্যে বিবাদ সংগঠিত হয়। এই ড়্গেত্রে আমাদের ঈদের আনন্দপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হয়।
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে সকলের মুখে হাসি। আমাদের দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন-বসিত্মবাসীর মানুষগুলো ঈদের সময় নিজেদের মত করে আনন্দ করে।
সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে যে যার পরিবারের জন্য ন্যূনতম জিনিস ক্রয় করে। বিভিন্ন সংগঠন ঈদুল-উল-ফিতরের ও ঈদুল আযহার সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দুস’ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়।
নিজেদের তত্ত্বাবধানে খাবার তৈরি করে এই দুস’মানুষদের মাঝে বিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে। এই দিনগুলোতে আমাদের দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পথশিশু ও ছিন্নমূল শিশুরা ফ্রিতে শিশুপার্কে বেড়াতে পারে। হোক না কয়েকটা দিন। তবুও এই কয়েকটা দিন আমাদের এই রিক্ত-সিক্ত শিশুরা পরম আনন্দে শিশু পার্কগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আবার এই শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে।
তাছাড়া বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণে পরিচালিত টিভি অনুষ্ঠানগুলো আমাদের ঈদ আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়।
সংযম, সহনশীলতা, সহানুভূতির শিড়্গা নিয়ে আমাদের এদেশের সকল সত্মরের মানুষগুলো যেন ঈদের দিনগুলোতে আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার জন্য আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। অনত্মত এই কয়েকটি দিন সকলে সকলের তরে এক হবে। তৈরি হবে এক নতুন ভুবন, থাকবে না দুঃখ, কষ্ট-বেদনা, থাকবে শুধু ঈদ আনন্দ। দেশের প্রতিটি মানুষ নিজের ধর্ম ও কৃষ্টি স্বাধীনভাবে পালন করে।
‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই ধারণাকে মেনেই সবাই নিজস্ব আঙ্গিকে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে। যখন ঈদ আনন্দ শুরম্ন হয়, আমাদের সাথে অন্য ধর্মাবলম্বী পরিচিতজনরা আমাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে আসে।
এই ঈদ আনন্দে আমাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবীর পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পরিচিতজনের শুভেচ্ছা বিনিময় আমাদের মহৎ হৃদয়ের পরিচয় বহন করে।
আমাদের প্রধান দুইটি ঈদের সময় গ্রামে ও শহরে সকলের আনন্দঘন সান্নিধ্য আমাদের ঈদ আনন্দ আরো বাড়িয়ে তোলে, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি দৃঢ় হয়।

Comment here