বিশেষ প্রতিবেদন

ইউপি নির্বাচনঃ পিরোজপুরে একাধিক কারণে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে!

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
প্রথম ধাপের অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে পিরোজপুরে ৩২ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার মধ্যে ১৪টি ইউনিয়নেই নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। আর এ ভরাডুবির জন্য মনোনয়ন ভুলকেই দায়ী করছে তৃণমুল।
৩২টি ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিপরীতে এক বা একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। বিদ্রোহী হয়েও ১১ টি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী ও প্রতীককে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে অধিকাংশ ইউনিয়নে ত্যাগী ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের অনেকেই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। কোথাও কোথাও এমন সব ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কেউ দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছেন। কারো বিরুদ্ধে সরকারী মালামাল আত্মসাতের মামলা রয়েছে। অনেকের সঙ্গে নেতাকর্মী ও দলের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে মাঠের নেতাকর্মীরা দল মনোনীত এসব প্রার্থীকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দেয়ায় দল নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেয়ায় নেতা-কর্মীরা তাদের পছন্দের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের বিজয়ী করছেন।
মশিউর রহমান নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মী জানান, জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক দেয়া উচিত। নৌকা একটি আবেগের নাম কিন্তু দুঃখ হয় তখন, যখন দেখি জনমত যাচাই না করে জনবিচ্ছিন্নদের নৌকা প্রতীক দেয়া হয়। যারা জনবিচ্ছিন্ন তারাই পরাজিত হয়েছেন।
জানা যায়, নাজিরপুর উপজেলায় ৪টি ইউপিতে প্রথম ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা সদর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন খান ও সেখমাটিয়া ইউনিয়নে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা আতিয়ার রহমান চৌধুরী নান্নু নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বুলুকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম বিলু আনারস প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থী বেলায়েত হোসেন বুলুর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে সরকারী মালামাল আত্মসাতের মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান ফকির বলেন, এ ইউনিয়নের নৌকার পরাজিত প্রার্থী বেলায়েত হোসেন বুলু দলীয় বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের দুরে রেখে জামাত-বিএনপি নিয়ে চলতেন। সাধারণ মানুষের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘরসহ টিউবওয়েল দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাত করেছেন। এমনকি সরকারী ব্রীজের মালামাল আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। এসব কারণে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সর্বপরি নৌকার জনসর্মথন থাকলেও নৌকার মাঝি ভালো না হওয়ায় এ ইউনিয়নে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে।
মালিখালী ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ও নৌকার প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠুকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী রুহুল আমিন বাবলু আনারস প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠুর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে তিনি সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন।
মালিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার হালদার বলেন, এ ইউনিয়নে নৌকার পরাজিত প্রার্থী সুমন মন্ডল মিঠু গত দশ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময়ে তার নানা কর্মকাণ্ডে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। গত দশ বছর দলীয় নেতাকর্মীদের সাথেও তিনি যোগাযোগ রাখেননি। এমনকি পরিষদের সদস্যদের সাথেও তার সমন্নয় ছিলো না। নিজের একক সিদ্ধান্তে পরিষদ পরিচালনা করেছেন। এসব কারণে দলীয় নেতাকর্মীসহ ভোটাররা তাকে ভয়কট করেছে।
মালিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মহসিন শিকদার বলেন, নৌকার প্রার্থী পারফেক্ট না হওয়ায় মালিখালীতে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। এ ভরাডুবির জন্য প্রার্থীর ব্যার্থতাই দায়ী। তাছাড়া তিনি আওয়ামী লীগেরই লোক নন। পরাজিত নৌকার সকল প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ তাদের কর্মকাণ্ডে তারা জনবিচ্ছিন্ন ছিলো। আর এ কারণেই ভোটাররা তাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছে।
স্বরূপকাঠি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. এস এম ফুয়াদ বলেন, নির্বাচন শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। স্বরূপকাঠিতে ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বাকি চারটিতে বিদ্রোহী। তারাও আওয়ামী লীগের লোক। অন্যকোন দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করায় জনগণ বিভক্ত হয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরূপকাঠি উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, যে চারটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী হেরেছেন। তারা সকলেই আওয়ামী লীগের দলীয় বর্তমান চেয়ারম্যান ছিলো। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। পুনরায় তারা দলীয় মনোনয়ন পেলেও জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া মনোনয়ন বাণিজ্যে করে এসব জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নাম কেন্দ্রে পাঠনো হয়েছে।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জামান ফুলু বলেন, যেসব ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন তারা নানা কারণে জণগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন ছিলো। দলের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ ছিলো না। এসব কারণে তারা পরাজিত হয়েছেন। অনেকেই বর্তমান চেয়ারম্যান থাকায় তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকায় জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছে।
যোগ্য ও গ্রহণযোগ্যদের প্রার্থী না করে বাণিজ্যের মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্নদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তৃণমূলের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. হাকিম হাওলাদার বলেন, এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। তবে যারা পরাজিত হয়েছেন এটা তাদের ব্যর্থতা।

Comment here