বিশেষ প্রতিবেদন

নাজিরপুরের বীরঙ্গনা লক্ষ্মী রাণীর কথা কারো মনে নেই!

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
“বাবা মা ছোট বোনের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে পালাইয়া ছিলাম। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়াও জানোয়ার গুলা ক্ষান্ত হয় নাই। জঙ্গলের মধ্যেও হানা দিছিলো। রাজাকারগো লগে লইয়া প্রথমে ওরা বাবা মায়েরে দড়ি (রশি) দিয়া বাইন্দা ফেলে। তারপর তাগো চোখের সামনে আমার ওপর নির্যাতন চালায়। অস্ত্র দেখাইয়া তুইল্লা নিয়া যায় মিলিটারি ক্যাম্পে। সারারাত রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমার ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালায়। আমি হার্টফেল (অজ্ঞান) হইয়া যাই। আমি মরছি ভাইব্বা (ভেবে) চেনা হুনা দুই রাজাকার আমারে ধান ক্ষ্যাতে ফেলাইয়া যায়। আশপাশের লোকেরা ক্ষত বিক্ষত দেহডারে বাবার কাছে পৌঁছাইয়া দিয়া যায়। দ্যাশ (দেশ) স্বাধীন  হওনের পর স্বাদী লালু মন্ডল আমারে ঘরে না তুইল্লা নতুন কইরা বিয়া করে। আশ পাশের লোকজন ঘৃণা করে। কিছু দিন পর বাবাও মারা যায়। এর পর ছোট ভাইর আশ্রয়ে আছি। ঘৃণা ছাড়া কেউ কিছু দেয় নাই”-বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার শাখারীকাঠী গ্রামের বীরঙ্গনা নারী ল²ী রাণী রায়।
১৯৭১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ল²ী ছিল সদ্য বিবাহিত নব পরিনিতা। পায়ের আলতা তখনও মুছে যায়নি। যুদ্ধের ডামাডোলে সে সময় লক্ষ্মীর জীবনে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। রাজাকার আলবদর আর পাকিস্তানি হায়নাদের পৈশাচিক লালসার শিকার হন সুন্দরী লক্ষ্মী। ৬৯ সালে ১৪ বছর বয়সে ল²ীর বিয়ে হয়েছিলো পার্শবর্তী গাবতলা গ্রামের লালু মন্ডলের সাথে। স্বামীর ঘরে সুখ সচ্ছলতা দুইই ছিলো। ৭১ এর যুদ্ধ তার জীবন থেকে সবটাই কেরে নেয়। লক্ষ্মী বলেন, আমারে বাঁচানোর জন্যই স্বামী বাবার বাড়ি পাঠাইয়া দিছিলো। বলছিলো তুমি দেখতে সুন্দর হায়নারা তোমার ক্ষতি করবে। কিন্তু সে ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেলো না লক্ষ্মী ।
৭১ এর ৩ নভেম্বর নাজিরপুরের শাখারীকাঠী গ্রামে রাজাকারদের সহয়তায় প্রবেশ করে পাকিস্তানি মিলিটারি। চালাতে থাকে ধ্বংস যজ্ঞ। সেই যজ্ঞেই বাবার চোখের সামনে হায়নার পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় মেয়ে লক্ষ্মী। এরপর রাতভর নির্যাতন করে পরিচিত দুই রাজাকার মৃত ভেবে একটি ধান ক্ষেতে ফেলে রেখে যায় ক্ষত বিক্ষত লক্ষ্মীকে। সেই ক্ষত সঙ্গী করে না পাওয়ার হাজার যন্ত্রনা বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন লক্ষ্মী রানী।
স্বামীর ঘরে ঠাঁই না পাওয়ার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় হয়েছিলো। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট ভাইয়ের কাছে। একটি ছোট্ট খুপরি ঘরে দিন কাটছে তাঁর। ভাই কুমোদ রায় বলেন, আমি সামান্য দিন মজুর নিজের সংসার আছে। বোনটারে সবাই ঘৃণার চোখে দেখে। রক্তের বোন আমি তো আর ফেলতে পারি না। নিজের ইচ্ছায় সে তো কোন পাপ করে নাই। তাই যা জোটে এক সাথে খাই। পরশমনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বুলু মিত্র বলেন, এলাকার সবাই জানে লক্ষ্মী রানী বীরঙ্গনা। কিন্তু এখন আর তার খোঁজ নেয়না। তার শরীরটা খুব খারাপ। চিকিৎসা দরকার। খাবারই জোটেনা, ডাক্তার পাবে কোথায়?
তার চোখের জল তখনও মাটিতে গড়িয়ে পরছিলো। চিকিৎসার অভাবে মাথাটা ঠায় সোজা করে রাখতে পারে না। মাথাটা দুলতে থাকে। চোখে হতাশার চিহ্ন।
একজন নারী জীবনের সাথে কতটা লড়তে পারে লক্ষ্মী রানী তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সরকারি সহযোগীতাও সে তেমন পায়নি। সহযোগীতা করার মত কোন আত্মীয় স্বজনও তার নেই। ৭১ এর পর স্বামী  হারা হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে কাজ করে পেট চালিয়েছেন।

 

Comment here