কাউখালী

করোনা মোকাবিলায় দিন-রাত কাজ করছেন কাউখালীর ইউএনও

রবিউল হাসান রবিন,কাউখালী থেকে:
বাংলাদেশে করোনার সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ার পর দম ফেলার সময় নাই স্থানীয় প্রশাসনের। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন সকলেই। তবে সরকারি নির্দেশনা ছাড়াও করোনার সংক্রমন রোধে অনেক কর্মকর্তা নিয়েছেন ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ। এরকমই একজন পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাঃ খালেদা খাতুন রেখা।
ভৌগোলিকভাবে কঁচা নদীর কোল ঘেঁষে এবং সন্ধ্যা নদী দ্বারা বিভক্ত ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কাউখালী উপজেলার একপাশে ঝালকাঠি জেলা এবং অন্যপ্রান্তে পিরোজপুরের নেছারাবাদ ও ভান্ডারিয়া উপজেলা। এছাড়া এ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গাবখান চ্যানেল থেকে প্রতিদিনই দেশী ও বিদেশী অসংখ্য জাহাজ চলাচল চলাচল করে। অন্যদিকে বরিশাল-পিরোজপুর-খুলনা আঞ্চলিক সড়কটিও একটি অংশ চলে চলে গেছে এ উপজেলার উপর দিয়ে। এ সব দিক বিবেচনায় অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে জেলার অন্যতম ছোট এই উপজেলাটি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও, এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় করোনা আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত হয়নি। আর কেউ যাতে আক্রান্ত না হয় এজন্য শুরু থেকে ব্যতিক্রমী কতগুলো পদক্ষেপ নিয়ে সফল হওয়ার পাশাপাশি প্রশংসিত হয়েছেন ৩১ তম বিসিএস এর এই কর্মকর্তা।
বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের মাধ্যমে উপজেলার কোথাও করোনা ছড়াতে না পারে এজন্য শুরুতেই তিনি পুলিশ প্রশাসনকে সাথে নিয়ে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া তাদের বাড়িতে লাল নিশানা টাঙিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সামগ্রী, বই ও খাবার সহ বিভিন্ন ধরণের উপহার সামগ্রীও দিয়েছেন যাতে করে তারা বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে উদ্বুদ্ধ হয়।
এছাড়া উপজেলার সর্বত্র করোনা বিরোধী কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সচেতন মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে গঠন করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যাদেরকে ফোন করলেই মানুষের দরজায় পৌছে যাচ্ছে খাদ্য সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সেবা। এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুকে প্রতিনিয়ত মানুষের পরামর্শ ও অভিযোগ নিয়ে সেই অনুযায়ী প্রতিনিয়ত ব্যবস্থাও নিচ্ছেন তিনি।
জনসমাগমের মাধ্যমে করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি বেশি থাকায়, মার্চের শেষের দিকে উপজেলার সকল সাপ্তাহিক হাটসহ ওষুধের ফার্মেসী বাদে সকল দোকান,হোটেল রেস্তোরা বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি এর উপর কঠোর নজরদারি অব্যহত রাখেন। তবে বাজার বন্ধ থাকলেও তেমন একটা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না সাধারণ মানুষকে। ইউএনও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে এলাকা ভাগ করে তিন চাকার ভ্যানগাড়ি, পিকআপ ভ্যান ও ট্রলারযোগে অর্ধশতাধিক ভ্রাম্যমান দোকান চালুর ব্যবস্থা করেছেন যেখান থেকে মানুষ তাদের পছন্দমত মাছ, মাংস, সবজি, মুদিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল ধরণের মালামাল ঘরে বসেই কিনতে পারছে। আর প্রতিটি বাহনের সাথে বিক্রেতার ফোন নম্বরও দেওয়া আছে এবং ফোন করলে তারা ছুটে যাচ্ছেন ক্রেতাদের কাছে। আর এতে করে উপজেলাব্যাপী সামাজিক ও শারিরীক দূরত্ব নিশ্চিত হয়েছে। এমনকি ইউএনও’র উদ্যোগে ভ্রাম্যমান সেলুনও চালু করা হয়েছে। আর ফোন পেলেই নরসুন্দররা পৌছে যাচ্ছেন মানুষের কাছে।

শুধু তাই নয়। স্থানীয় ফার্মেসীগুলোর ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউনএও’র ফেসবুকে। এদের যে কাউকেই ফোন করলে বাড়িতে পৌছে যাচ্ছে ঔষধ।
দুর্যোগকালীন এ সময়ে গৃহপালিত প্রণিদের যাতে কোন কষ্ট না হয়, এজন্য উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসের উদ্যোগে ভ্রাম্যমান প্রাণি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করেছেন তিনি যার মানুষের বাড়িতে গিয়ে গৃহপালিত প্রাণিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
কৃষকদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনা আতঙ্কের কারণে অলস সময় কাটানো কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার সবজির বীজ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে কৃষকদের হাতে এই বীজ তুলে দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা.খালেদা খাতুন রেখা। বিনামূল্যে এই বীজ পেয়ে কৃষকরাও খুশি। আঙ্গিনায় এই বীজ বপন করছেন তারা। এতে একদিকে যেমন পতিত জমির ব্যবহার নিশ্চিত হবে, অপরদিকে করনো পরবর্তী সময়ে সবজির ঘাটতি দূর হবে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে তাদের কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেখা। শিক্ষার্থীরা যাতে বিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন এই সময় অবহেলায় অপচয় না করে লেখাপড়ার প্রতি যতœশীল হয় এজন্য তিনি চিঠির মাধ্যমে তাদের কাছে আহবান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ থেকে লোকজন ছুটে আসছে গ্রামাঞ্চলে। এসব লোকদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ৫টি ইউনিয়নে ৭টি বিদ্যালয়কে নির্ধারণ করার পাশাপাশি তাদের সার্বিক সুবিধার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য একটি করে টিম গঠন করেছেন যারা সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজ নিচ্ছেন। এছাড়া কেউ যাতে নদী পথে লুকিয়ে উপজেলায় প্রবেশ করতে না পারে এজন্য নৌ পুলিশের সহায়তায় ভাসমান টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এছাড়া সন্ধ্যা নদী দ্বারা বিভক্ত গ্রামগুলোতে সরকারি সহায়তা পৌছে দেওয়ার জন্য চালু করেছেন ইঞ্জিনচালিত ট্রলার দিয়ে সেবার নৌকা। এসব ট্রলারে খাদ্য সহায়তা নিয়ে ইউএনও নিজেই ছুটে যাচ্ছেন দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে। এমনকি গাবখান চ্যানেলের কাউখালী প্রান্তে নোঙর করা জাহাজগুলোতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগতদের কূলে উঠতে দিচ্ছেন না। বরং ট্রলারে করেই প্রতিদিনই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের কাছে। এছাড়া সরকারি আদেশ অমান্যকারীদের নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে যাতে করে তারা সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। আর উপজেলাকে জীবানুমুক্ত রাখতে নিয়মিত ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে করা হচ্ছে জীবানুনাশক স্প্রে।
সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকায় সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া কন্যা সন্তান ও পরিবারের জন্যও খুব একটা সময় দিতে পারেন না তিনি। তবে এত কষ্ট স্বীকার করার পরও যদি উপজেলাবাসী করোনা মুক্ত থাকে এটাই বড় পাওয়া বলে জানান এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আর সকল বিষয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগীতা করায় তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।

Comment here