আলোকিত মুখবিশেষ প্রতিবেদন

আলী হায়দার খান বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি হিসাবে

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
(১) গত ৫জুন ছিল ষাটের দশকের প্রখ্যাত ছাত্র নেতা, ৬২’টির আয়উব বিরোধী আন্দোলন, ৬৯’ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭0’ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী, একসময়কার ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমৃত্যু প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক জনাব এডভোকেট আলী হায়দার খান সাহেবের প্রয়াণের তৃতীয় বাষিকী।
একজন প্রতিবাদি-আপোষহীন সৎ মানুষ হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। কিন্তু পিরোজপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে আমরা অনেকেই তাঁকে ভুলে যেতে বসেছি। মৃত্যুর পর পিরোজপুরের সামাজিক অধিপতিরা বলতে গেলে কিছুই করেন নি। একটি শেকসভা বা স্মরণসভা করার সুযোগ থাকলেও তার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যাইহোক- এ প্রতিবেদক দায়বদ্ধতা থেকে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানার চেষ্টা করেছেন জনাব এডভোকেট আলী হায়দার খান সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা কথা।
(২) জনাব আলী হায়দার খান ১৯৩৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর সদরের তেজদাসকাঠি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাশেম আলী খান এবং মাতা সায়রা বানু।
তিনি ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের জি এস ও ১৯৬৫ সালে ভিপি নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থেকে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
সে বছর পুর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খানকে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাবর্তণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করায় এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে আন্দোলন করার অপরাধে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের জন্য বহিস্কার করা হয় এবং নিরাপত্তা রাজবন্দী হিসেবে দু’বছর জেল খাটেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পুনরায় ইকবাল হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। একই বছর তাকে পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় ন্যাপের নেতা হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্তে পিরোজপুর চলে আসেন ও মহুকুমা আইনজীবী সমিতিতে যোগ দেন।

১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ৪ জনের কমান্ড কাউন্সিল গঠিত হলে তিনি সেই কাউন্সিলের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলার দ্বায়িত্বে থেকে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। তীব্র যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম একজন সংগঠক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডের-২৪৫ এ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর স্বাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা রয়েছে।)
৭০’র নির্বাচন থেকে দলীয় সিদ্ধান্তে মোজাফ্ফর ন্যাপের সদস্য হয়ে পিরোজপুরে ৮০’র দশক পর্যন্ত রাজনীতি করেছেন। ১৯৮৬ সালে পিরোজপুর-১ আসনে ৮ দলীয় প্রার্থী হয়ে নৌকা মার্কা নিয়ে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে আমৃত্যু দলের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।
(৩) দেশের অন্যান্য স্থানের মত তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার প্রতিটি গ্রামে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দূর্গ। ৭ মার্চ হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মিছিল, মিটিং প্রতিদিন কমবেশি হত। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ, আওয়ামী লীগের নেতরা বেশ সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সংগ্রাম পরিষদের জনসভা চলছিল গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে। এই সভায় তদানীন্তর এম, এন,এ অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস, নির্মম হত্যাকান্ডের বিবরন দিয়ে ভাষন দেয়ার সময় স্বাধীনতাকামী উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে ‘অস্ত্র চাই অস্ত্র চাই’ ধ্বনি দিতে থাকলে তিনি জনতাকে আশ্বস্ত করে বলেন আজ এখনই অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে তোমাদের হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতা অস্ত্রাগারের দিকে এগিয়ে যায়। পিরোজপুরের মহকুমা প্রশাসকের অফিস সংলগ্ন অস্ত্রাগারটি লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে অ্যাডেভোকেট আলী হায়দার খান সাহেব অন্যতম। তাঁর পরিকল্পনায় ও যুগোপযোগী নেতৃত্বগুণে সুশৃংখলভাবে এখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয় এবং ২৮ মার্চ পিরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে সাধারণ মানুষদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
পিরোজপুর পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশের পর ১৯ মে ১৭৯১ অস্ত্রাগারের আরএসআই গোলাম মাওলা বাদী হয়ে পিরোজপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পিরোজপুর থানার এই ৫নং মামলাটিতে ৫৫ জনকে আসামী করা হয়। ঐতিহাসিক এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলার আসামিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোজাফফর ন্যাপ নেতা আলী হায়দার খান।

(৪) বৈবাহিক সুত্রে আপন আলোয় আলোকিত জনাব হায়দার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ ড. ফয়জুর রহমান ও শহীদ জায়া আয়েশা ফয়েজের বড় জামাতা। তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুফিয়া হায়দারের প্রবাসী তিন কন্যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠত। শেষ জীবনে তিনি ঢাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন এবং ২০১৭ সনের ৫ জুন তিনি দীর্ঘদিনের কিডনি, ডায়েবেটিস ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য স্বনামধন্য বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ, প্রথিতযশা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব তাঁর তিন শ্যালক।
(৫) স্বাধীনতার আগে ও পরে মরহুম আলী হায়দার খান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি হিসাবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর কর্ম, তাঁর স্মৃতিকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখার জন্য অনতিবিলম্বে তাঁর স্মারকগ্রন্থ এবং প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আশা করি পারিবারিকভাবে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
আলী হায়দার খানের বড় মেয়ে শবনম হায়দার তার এফবিতে লিখেছেন, “আজ থেকে ঠিক ৩ বছর আগে,আমার বাবা আলী হায়দার খান আমাদের কে ছেড়ে চলে যান।বাবা শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় যায়গায় পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা কবর স্থানে। আমার বাবা যে খানে শুয়ে,আছেন সে যায়গা আমার কত খানি প্রিয় সেটা চলে গেলে আমি টের পেলাম।” তিনি আরো লিখেন, আমার বাবা কে নিয়ে একটি স্মরণিকা বের করতে চাচ্ছি, তা আগামী বই মেলায় প্রকাশ করতে চাচ্ছি।।

তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১) সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫
২)পিরোজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস/হুমায়ুন রহমান
৩)পিরোজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস/ কায়সার ফিরোজ
(৪)বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র /অষ্টম খণ্ড/পৃষ্ঠা-২৪৫/১৬ আগস্ট ১৯৭২
(৫) মরহুম আলী হায়দার খানের বড় মেয়ে শবনম হায়দার।

Comment here